১৯৭৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত রক সঙ্গীত ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পর্ককে জানতে পড়ুন।

১৯৭৪ সালের শেষের দিকে গৌতম চট্টপাধ্যায়ের হাত ধরে জন্ম ব্যান্ডটির। প্রথমে ব্যান্ডটির নাম ছিল‘সপ্তর্ষী’। পরবর্তীতে রঞ্জন ঘোষাল এর নাম প্রস্তাব করেন ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’। নাম টি নেয়া হয়েছে কবি জীবনান্দ দাশের ‘ঘোড়া’কবিতার‘মহিনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জোৎস্নার প্রান্তরে’ লাইনটি থেকে। 

‘মহিনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ড টি কে আসলে একটি নির্দিষ্ট ঘরানাতে সীমাবদ্ধ করা মুশকিল বাবলা যেতে পারে ব্যান্ডটি কোন নির্দিষ্ট জেনরার গান নিয়ে পড়ে থাকে নি বরং প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গিয়েছে গান নিয়ে। তবে তাদেরকে অনেকেই ষাট এর দশকে বব ডিলানের আরবান ফোক আন্দোলনের সাথে তুলনা করে থাকে। সেই হিসেবে তাদের অনেকটা বাংলাফোক রক ধারার বলা যেতে পারে।ব্যান্ডটির জন্ম এমন এক সময়ে যখন পশ্চিম বাংলার মানুষেরা সিনেমার সুরেলা,রোমান্টিক গানের দ্বারা প্রচন্ড ভাবে সম্মোহিত ছিল এবং সম্পূর্ণ নতুন কিছুবা নতুন ধরণের গান গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না।


ফলাফল যা হবার তাই হল-সনাতন প্রথা বিরোধী গানের কথা,ব্যাতিক্রমী সুর,তৎকালীন  সময়ের জন্য অনেকটাই উদ্ভট সংগীত আয়োজন সেই সময়ের শ্রোতারা গ্রহণ করে নি। আর করবেই বা কিভাবে? সমসাময়িক শ্রোতারা যখন কাল্পনার মধুময় স্রোতহীন নদী সুরেলা প্রেমের গানের ভেলাতে পাড়ি দিতে বিভোর তখন মহিনের ঘোড়াগুলির গানের কথা ছিল যেনসেই কল্পনার মধু জগৎ থেকে বাস্তবতার শুকনো কঠিন মাটিতে আছড়ে ফেলার মত। তাদের গানের কথা এমন সব বিষয় কে সামনে নিয়ে এসেছিল যা অন্যদের কাছে গানের বিষয় হিসেবে চোখেই পড়ত না- 

রাজনীতি,দারিদ্র্য,অবিচার,বিপ্লব,প্রেম,একাকিত্বএমনকি ভিক্ষাবৃত্তি এবং পতিতাদের জীবন সংগ্রামকেও তারা তাদের গানের কথা তেনিয়ে এসেছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এসব-ই ছিল সমসাময়িক শ্রোতাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য!!গৌতম এর একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিকমতাদর্শ ছিল এবং তিনি বাম রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন।ব্যান্ডের সাবেক সদস্য আব্রাহাম মজুমদারের ভাষ্যমতে গৌতম ‘নকশাল আন্দোলনের’ সাথেও জড়িতছিলেন। তার রাজনৈতিক মতাদর্শের ছায়াতার গানেরমধ্যে পাওয়া যায়। 

নব্বই এর দশকে সুমনচট্টপাধ্যায়,অঞ্জন দত্ত,নচিকেতা’র হাত ধরে‘জীবনমুখী’ ধারার বাংলা গান জনপ্রিয়তা পেলে ও মূলত বাংলা গানে এই ধারার প্রথম অনুপ্রবেশঘটে‘মহিনের ঘোড়াগুলি’র হাত ধরেই।ব্যান্ডটির যাত্রা পথ অনেক চরাই-উৎরাই,ভাঙ্গা-গড়ারমধ্য দিয়ে। ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হলেও সে সময় এর স্থায়িত্ব ছিলমাত্র ৬বছর। কারণ? ওই যে, তৎকালীন বাঙ্গালীর নতুন কিছু কে গ্রহণ করার অক্ষমতা। ১৯৮১ সালে ব্যান্ডটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। এই ৬ বছরে তারা৩ টি এ্যালবাম রেকর্ড করলেও কোনটি-ই জনপ্রিয়তা পায়নি, যদিও তারা এই সময়ে প্রায় ১৫/১৬ টির মত স্টেইজ পারফর্মেন্স করেছিল। রবীন্দ্রসদন,ম্যাক্সমুলারভবন,সেন্ট পল’স ক্যাথেড্রাল মিশন গ্রাউন্ড সহ বিভিন্ন যায়গায় তারা স্টেইজ পারফর্মেন্স করেছিল। 

স্টেইজ এ তাদের উপস্থাপনাও ছিল ব্যাতিক্রমধর্মী, এমন কি তাদের কনসার্টের টিকেট ও ছিলসম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। কখনো তাদের টিকেট ছিল টেলি গ্রামের মত দেখতে,আবার কখনো টিকেটে থাকত সব ব্যান্ড সদস্যের আঙুলেরছাপ! 

পূনর্গঠনঃ১৯৮১ সালে বিলীন হয়ে যাবার পর ৮০’র দশকের শেষের দিকে কলকাতা প্রসিডেন্সি কলেজের সুব্রত ঘোষাল নামের একটি ছেলে মহিনের ঘোড়াগুলির “ভাল লাগে জোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে” গানটি শুনে গৌতম চট্টপাধ্যায়ের প্রচন্ডভক্ত হয়ে যান এবং তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েতাঁকে খুঁজে বের করেন। সুব্রত’র সাথে কিছুদিন জ্যামিং করার পর মনি দা(গৌতম এর ডাকনাম ছিল মানিক) তথাগৌতম চট্টপাধ্যায় আবার মহিনের ঘোড়াগুলি পূনর্গঠনের স্বীদ্ধান্ত নেন। এরপর দিনের পরদিন ,মাসের পর মাস তারা আরও কয়েকজন নতুন প্রজন্মের ছেলেদের সাথে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন বাংলা গানের সনাতন ধারাকে ভেঙ্গে নতুন কিছু করার।

ব্যান্ড লাইন আপঃ 
(১) গৌতম চট্টপাধ্যায় 
(২) তাপস দাশ 
(৩) আব্রাহাম মজুমদার
(৪) প্রদীপ চট্টপাধ্যায় 
(৫) রঞ্জন ঘোষাল 
(৬) বিশ্বনাথ চট্টপাধ্যায়
(৭) তপেশ বন্দপাধ্যায়
(৮) রাজা ব্যানার্জী


অবশেষে নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি সুব্রত সহ আরও কয়েকজনের অনুপ্রেরণায় গৌতম স্বীদ্ধান্ত নেন ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’রপুনঃপ্রকাশের। ১৯৯৫ সালে “আবার বছর কুড়ি পরে”নামের ‘ক্যাসেট’ এ্যালবাম টি প্রকাশিত হয় কলকাতা বইমেলায়। বিশ বছর আগে যে গানগুলি মানুষ অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিল,বিশ বছর পর সেগুলোই প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায়। 

শুরু হয় মহিনের ঘোড়া গুলির সফলতার অধ্যায়।দুঃখের বিষয় বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান ব্যাক্তিটি (গৌতম) ১৯৯৯ সালেহঠাৎ ই হার্টএ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। আবার থেমে যায়মহিনের ঘোড়াগুলি’র যাত্রা। গৌতমের মৃত্যুতে ওইসময়ের তার অনুসারীরা প্রচন্ডভাবে মুষড়ে পড়েন এবং গোতম কে ট্রিবিউট করে একটি এ্যালবাম বের করেন “মনি ছাড়া শূন্য লাগে”নামে।। 

মহিনের ঘোড়াগুলি’র এ্যালবাম সমূহঃ

(১) সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক(১৯৭৭)
(২) অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব (১৯৭৮) 
(৩) দৃশ্যমান মহিনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯)
(৪) আবার বছর কুড়ি পরে (১৯৯৫)
(৫) ঝরা সময়ের গান (১৯৯৬) 
(৬) মায়া (১৯৯৭) 
(৭) খ্যাপার গান (১৯৯৯)
(৮) আবার কুড়ি বছর পরে এক্সটেন্ডেড সি ডি(১৯৯৯)। 


POST CREDIT :পিয়াস হাসান

Comments

Popular posts from this blog

শাবনূরের লাইফস্টাইল অজানা অনেক তথ্য I আসল নাম | উচ্চতা I ওজন I শারীরিক পরিমাপ | বয়স | পড়ালেখা | স্বামী | ক্যারিয়ারের অর্জন | বাড়ি | জীবনী এবং উল্লেখযোগ্য সিনেমায় ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্ককে জানতে অবশ্যই পড়ুন

বাংলাদেশী ব্যান্ডের আন্ডাররেটেড গান সমূহের তালিকা দেয়া হলো । নতুন কিছু গানের স্বাদ পেতে অবশ্যই পড়ুন।

পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ২০ টি বস্তু, যা এতটাই দামী আপনি শুনে অবাক না হয়ে পারবেন না,জানতে অবশ্যই পড়ুন।